ডিবি হারুনের সম্পদ খোঁজে হাঁপিয়ে উঠেছেন দুদক

পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় সমালোচিত ও নানা অন্যায়ের হোতা সাবেক ডিবি প্রধান পলাতক ডিআইজি হারুন অর রশীদের বিপুল সম্পদের সন্ধান পেয়েছেন দুদক। একটি গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকে সম্প্রতি সরকারের উচ্চ পর্যায়ে পাঠানো প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ডিবি হারুনের সম্পদের খোঁজে হাঁপিয়ে উঠেছেন দুদক কর্মকর্তারা। ঢাকা, ঢাকার আশপাশ এলাকা এবং বিদেশে এই বিপুল সম্পদ নিজের, পরিবার ও আত্মীয়স্বজনের নামে গড়ে তুলেছেন বিতর্কিত এই পুলিশ কর্মকর্তা। কীভাবে একজন পুলিশ কর্মকর্তা এত বিপুল পরিমাণ সম্পদের মালিক হতে পারেন, তা নিয়ে ওই গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বিস্ময় প্রকাশ করা হয়েছে। পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিপুল পরিমাণ সম্পদের মালিক বনে যাওয়া শতাধিক পুলিশ কর্মকর্তার তথ্য সংগ্রহ করছে ওই গোয়েন্দা সংস্থা। সরকারের একটি দায়িত্বশীল সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

||
ওই গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, সপরিবারে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব আছে পুলিশের পলাতক ডিআইজি, সাবেক ডিবি প্রধান হারুন অর রশীদের। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের নিউ হাইড পার্ক এলাকায় স্ত্রীর নামে পাঁচ মিলিয়ন ডলারের একটি বাড়ি কিনেছেন হারুন। উত্তরা ৩ নম্বর সেক্টরের ২০ নম্বর রোডে (লেকপাড়ের রোডে) রয়েছে ছয়তলা একটি আলিশান বাড়ি। এটি গেস্ট হাউস হিসেবে ব্যবহৃত হয়। একই রোডের মাথায় আটতলা আরেকটি বাড়ি আছে হারুনের। এই বাড়ির চতুর্থ তলায় পরিবার নিয়ে থাকতেন। উত্তরা ৩ নম্বর সেক্টরের ৭ নম্বর রোডে ১০ কাঠা জায়গার ওপর একটি ১০ তলা মার্কেট। এটি হারুনের শ্বশুরের নামে করা হয়েছে। উত্তরা ১২ নম্বর সেক্টরের সোনারগাঁও জএই বাড়িটি বন্ধক রেখে শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া হয়েছে। উত্তরা ১৩ নম্বর সেক্টরের শাহ মখদুম এভিনিউয়ে একটি প্লটের মালিক হারুন। এখানে কয়েকটি দোকান ভাড়া দেওয়া আছে। উত্তরা ১৩ নম্বর সেক্টরের সোনারগাঁও জনপথ রোডে প্লট এক ব্যক্তির কাছে ভাড়া দেওয়া আছে। ৩ নম্বর সেক্টরে বহুতল বাণিজ্যিক ভবন, ১৩ নম্বর সেক্টরে আরও একটি ছয়তলা ভবন, ১০ নম্বর সেক্টরের পাঁচ কাঠার প্লট, ১১ নম্বর সেক্টরের ছয় নম্বর রোডে ১০ কাঠার দুটি প্লটের মালিক হারুন। শেষ দুটি প্লটের মধ্যে একটিতে টিনশেড ঘর বানিয়ে ভাড়া দেওয়া হয়েছে এবং অন্যটি গোডাউন। ১২/১৪ নম্বর সেক্টরের ২০ নম্বর রোডে প্লট চারটি কোম্পানির শোরুম হিসেবে ভাড়া দেওয়া। ১০ নম্বর সেক্টরের ১২ নম্বর রোডে একটি বাড়ির পাঁচতলায় কথিত মামা জাহাঙ্গীরের অফিস। এই অফিসেই হারুনের সব সম্পত্তির কাগজপত্র রক্ষিত থাকে বলে জানিয়েছে জাহাঙ্গীরের ঘনিষ্ঠ সূত্র।

উত্তরা ৩ নম্বর সেক্টরে একটি প্লট হিরন নামের এক ব্যক্তির কাছে ৩২ কোটি টাকায় বিক্রি করে হারুন। ৩ নম্বর সেক্টরের সাবেক ৯ নম্বর রোড বর্তমানে রবীন্দ্র সরণিতে রয়েছে একটি প্লট। ১১ নম্বর সেক্টরে আরেকটি প্লট, ১৩ নম্বর সেক্টরে একটি প্লট, উত্তরা থার্ড ফেইসে ও পূর্বাচলে কয়েক ডজন ফ্ল্যাট রয়েছে হারুনের।

ওই গোয়েন্দা প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, বনানী কবরস্থানের দক্ষিণ পাশে ২০ কাঠার প্লট দখল করে একটি কোম্পানির কাছে ৭০ কোটি টাকায় বিক্রি করেন হারুন। টঙ্গীর সাতাইশ মৌজায় আট বিঘা জমিতে কোনো অনুমোদন ছাড়াই নির্মাণ করা হচ্ছে একটি প্রতিষ্ঠান। টঙ্গীর আশুলিয়া মৌজায় ছায়াকুঞ্জ-৫ আবাসিক প্রকল্পের ভেতরে ১২ বিঘা জমিতে গড়ে তোলা হচ্ছে আবাসিক হোটেল। এছাড়া হারুন অর রশীদের নামে কিশোরগঞ্জে মিঠামইনে প্রেসিডেন্ট রিসোর্ট নামে একটি বিলাসবহুল রিসোর্ট রয়েছে। যেটি পরিচালনা করেন হারুনের ভাই ডাক্তার শাহরিয়ার। গাজীপুরে রয়েছে সবুজ পাতা রিসোর্ট এবং ‘গ্রিন টেক’ নামে আরও একটি বিলাসবহুল রিসোর্টের শেয়ার। এ ছাড়া নন্দন পার্কেও শেয়ার আছে হারুনের। আছে আমেরিকান ডেইরি নামে একটি কোম্পানিতে বিনিয়োগ। এই কোম্পানির এমডি হারুনের স্ত্রী। ময়মনসিংহের ত্রিশালের সাবেক এমপি আনিসের সঙ্গে ফিশারিজ এবং রেস্টুরেন্টের যৌথ ব্যবসা আছে হারুনের।

বিদেশে অর্থ পাচারের সুবিধার জন্য গড়ে তোলা হয় নিজস্ব মানি এক্সচেঞ্জ। ঢাকায় এই প্রতিষ্ঠানের অফিস পুরানা পল্টনের আজাদ প্রোডাক্টসের গলিতে। কার্যক্রম পরিচালনায় দুবাইয়ে আছে আরেকটি অফিস। এই মানি এক্সচেঞ্জ পরিচালনা করেন এডিসি সাইফুল ইসলামের দুই ভাই। একজন থাকেন দেশে, আরেক ভাই রিফাত অবস্থান করেন দুবাই।

একটি গোয়েন্দা সংস্থার একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা ইনকিলাবকে বলেন, কিশোরগঞ্জের মিঠামইন উপজেলার ঘাগড়া ইউনিয়নের হোসেনপুর গ্রামে জন্ম নেওয়া হারুন অর রশীদ মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে চাকরি পান। পরে জানা যায়, তার বাবা ছিলেন ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা। ২০০১ সালে তার পদায়ন আটকে দেয় বিএনপি সরকার। ওয়ান-ইলেভেনের সময় চাকরি স্থায়ী হয় তার। ২০১১ সালের ৬ জুলাই সংসদ ভবনের সামনে তৎকালীন চিফ হুইপ বিএনপি নেতা জয়নুল আবদিন ফারুককে শারীরিকভাবে হেনস্তা করেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হারুন। সেই থেকে শেখ হাসিনার নেক নজরে, তরতর করে পদোন্নতি আর গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় পদায়ন হয় তার। এই সুযোগে হারুন হয়ে ওঠেন বেপরোয়া। যেখানেই গেছেন, তা নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, পুলিশ সদর দপ্তর কিংবা ডিবি—সব জায়গাতেই বিতর্কে জড়ান এই পুলিশ কর্মকর্তা। ঘুষ, চাঁদাবাজি, ডিবিতে ডেকে নিয়ে টাকা আদায়, জিম্মি করা, আটকে রেখে নির্যাতন, জমি দখল, গুম-খুন, মিথ্যা মামলার হয়রানি—হেন কাজ নেই যা করেননি তিনি।

ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, পুলিশের সবচেয়ে বিতর্কিত কর্মকর্তাদের অন্যতম এই হারুন। তার বিরুদ্ধে সমাজের নানা শ্রেণির বিশেষ করে ধনিক মানুষকে নানাভাবে ফাঁদে ফেলে কোটি কোটি টাকা আদায় করেছেন তিনি। ঢাকার বেশ কয়েকজন বড় ব্যবসায়ীর জমি দখল, মার্কেট, দোকান ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দখলের কাজে অন্যায় সহযোগিতা করে কামিয়েছেন শত শত কোটি টাকা। মোটা অঙ্কের টাকা খরচ করেই ৫ আগস্ট আওয়ামী সরকার পতনের পর নিজেকে আড়াল করে রেখেছেন বলে ওই কর্মকর্তা মন্তব্য করেন।