
কার্গো ভিলেজের আদ্যোপান্ত
বিমানবন্দর মানে শুধু যাত্রীদের জন্য নয়। এর পেছনে চলে একটি গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম—কার্গো। আর এই কার্গো কার্যক্রমের মূল কেন্দ্র হলো কার্গো ভিলেজ। এটি এমন একটি জায়গা যেখানে সব ধরনের পণ্য গ্রহণ, সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং প্রেরণ করা হয়।
কার্গো ভিলেজ কী?
কার্গো ভিলেজ হলো বিমানবন্দরের একটি বিশেষ কমপ্লেক্স, যা পুরো কার্গো লজিস্টিক কার্যক্রমের জন্য দায়ী। এখানে আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ উভয় ধরনের পণ্য পরিচালনা করা হয়। ভিলেজটি শুধু পণ্য গ্রহণের জায়গা নয়, বরং এটি পণ্য সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ, নিরাপত্তা এবং দ্রুত প্রেরণের কেন্দ্রবিন্দু।
কার্গো ভিলেজে কী থাকে?
স্টোরেজ ও ওয়্যারহাউজ- যেখানে পণ্য অস্থায়ীভাবে রাখা হয়। তবে তাজা ও ভঙ্গুর পণ্য আলাদা হিমাগার বা নিয়ন্ত্রিত স্টোরেজে রাখা হয়। কাস্টমস ও প্রক্রিয়াজাতকরণ এলাকা- যেখানে কাস্টমস ক্লিয়ারেন্স, শুল্ক হিসাব, কাগজপত্র যাচাই এবং এক্স-রে স্ক্যানার ও নিরাপত্তা চেক করা হয়। লোডিং ও আনলোডিং জোন- এখানে বিমানে পণ্য লোড ও আনলোডের জন্য হ্যান্ডলিং মেশিন, ফর্কলিফ্ট ও কনভেয়ার বেল্ট ব্যবহার করা হয়। অফিস ও প্রশাসনিক ভবন- এখানে কার্গো অপারেটর, শিপিং কোম্পানি ও বিমান কর্তৃপক্ষের অফিস থাকে। আর এর নিরাপত্তা ব্যবস্থা হিসেবে থাকে ২৪ ঘণ্টা সিসিটিভি নজরদারি, সীমিত প্রবেশাধিকার এবং রিমোট কন্ট্রোল ফায়ারফাইটিং রোবট, যেগুলো অগ্নিকাণ্ডের সময় ব্যবহৃত হয়। এছাড়াও এখানে আরও বিশেষ কিছু সুবিধা রয়েছে। যেমন: হিমাগার, কনটেইনার ডিপো, বিশেষ বা বিপজ্জনক পণ্য হ্যান্ডলিং, ট্র্যাকিং ও ডকুমেন্টেশন সেন্টার।
কার্গো ভিলেজে আগুন লাগার নেপথ্যে লুকিয়ে থাকা ঝুঁকি
বিমানবন্দরের ব্যস্ততম অংশগুলোর একটি হলো কার্গো ভিলেজ—যেখানে প্রতিদিন টন টন পণ্য ওঠানামা করে। কিন্তু এই গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাটিই মাঝে মাঝে হয়ে ওঠে বিপদের কেন্দ্র। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কার্গো এলাকায় আগুন লাগার ঘটনা নতুন করে ভাবাচ্ছে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষকে। এখানে থাকে ওয়্যারহাউজ, কনটেইনার টার্মিনাল, কাস্টমস চেকপয়েন্ট, ফ্রিজার রুম ও প্রশাসনিক অফিস। যেহেতু এখানে তেল, ব্যাটারি, রাসায়নিক দ্রব্য, ইলেকট্রনিক পণ্য থেকে শুরু করে দ্রুত পচনশীল খাবার—সবই রাখা হয়, তাই আগুনের ঝুঁকিও তুলনামূলক বেশি।
কীভাবে কার্গো ভিলেজে আগুন লাগতে পারে?
কার্গো ভিলেজে আগুন লাগার বেশ কিছু সাধারণ কারণ রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে- ফ্ল্যামেবল পণ্য থেকে বিস্ফোরণ। অর্থাৎ তেল, গ্যাস, ব্যাটারি বা কেমিক্যাল জাতীয় দ্রব্য ঠিকভাবে সংরক্ষণ না করলে তা থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়। দ্বিতীয়ত, ইলেকট্রিক শর্ট সার্কিট। গুদামে ব্যবহৃত বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি ও তারের ত্রুটি থেকে আগুন লাগতে পারে। তৃতীয়ত, মানবিক ভুল। অর্থাৎ ধূমপান, স্পার্ক তৈরি, বা ভুলভাবে পণ্য সরানোর সময় অমনোযোগও বড় বিপদের কারণ হয়। চতুর্থত, তাপমাত্রার প্রভাব। কিছু রাসায়নিক দ্রব্য অতিরিক্ত তাপে নিজে থেকেই প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে, যা আগুনের সূত্রপাত ঘটাতে পারে।
বিশ্বজুড়ে বিমানবন্দরের কার্গো টার্মিনালে আগুনের উদাহরণ
২০২০ সালে দুবাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো টার্মিনালে ব্যাটারি সংরক্ষণ এলাকায় ভয়াবহ আগুন লাগে। পরে তদন্তে জানা যায়, ব্যাটারি যথাযথভাবে আলাদা না করে রাখায় শর্ট সার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়েছিল। ২০১৯ সালে চীনের সাংহাইয়ের কার্গো ওয়্যারহাউজে রাসায়নিক দ্রব্য থেকে সৃষ্ট আগুনে পুড়ে যায় শতাধিক টন পণ্য। দাহ্য পদার্থের পাশে বৈদ্যুতিক সংযোগ থাকাই ছিল প্রধান কারণ। ২০১৬ সালে নিউইয়র্কে ইলেকট্রনিক কার্গো থেকে শর্ট সার্কিট হয়ে আগুন লাগে। তাৎক্ষণিকভাবে অ্যালার্ম সাড়া দিলেও আগুন ছড়িয়ে পড়ে কয়েকটি সংরক্ষণ কন্টেইনারে।
কার্গো ভিলেজের নিরাপত্তা ব্যবস্থা
এ ধরনের ঝুঁকি ঠেকাতে আধুনিক কার্গো ভিলেজে এখন বহুমুখী নিরাপত্তা ব্যবস্থা রাখা হয়। এর মধ্যে রয়েছে- অগ্নি শনাক্তকরণ ব্যবস্থা, যা ধোঁয়া বা তাপমাত্রা বেড়ে গেলে সঙ্গে সঙ্গে অ্যালার্ম বেজে ওঠে। স্প্রিংকলার ও ফায়ার হাইড্রান্ট- প্রতিটি ওয়্যারহাউজে স্বয়ংক্রিয় পানি স্প্রিংকলার ব্যবস্থা থাকে। রিমোট কন্ট্রোল ফায়ারফাইটিং রোবট- এগুলো সরাসরি মানব হস্তক্ষেপ ছাড়াই আগুন নিয়ন্ত্রণের আধুনিক ব্যবস্থা। এছাড়াও ২৪ ঘণ্টা সিসিটিভির মাধ্যমে প্রতিটি সংরক্ষিত এলাকা নজরদারির মধ্যে রাখা হয়। সেইসাথে থাকে প্রশিক্ষিত কর্মী, আর তাদের সে বিষয়ে নিয়মিত প্রশিক্ষণও দেয়া হয়।
কার্গো ভিলেজ একটি দেশের অর্থনীতি ও বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রবিন্দু, কিন্তু এর ভেতরে পণ্য ও প্রযুক্তির বৈচিত্র্যের কারণে সবসময় এক ধরনের ঝুঁকি লুকিয়ে থাকে। আর সেই ঝুঁকি মোকাবিলায় কঠোর নিরাপত্তা, নিয়মিত পরিদর্শন ও প্রযুক্তিনির্ভর ব্যবস্থাপনা দরকার বলে মত নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের।