তিন বেলা ভাত খাওয়া লোক আমরা। এক সপ্তাহ ধইরা এক বেলাও ভালো কইরা খাইতে পারি না।”
আমরা শুকানা খাবার কত খাইব? এখন কিছু চাইল-ডাইল দেন।” ত্রাণবাহী ট্রাক দেখে তার কাছে এসে ফেনী সদর উপজেলার বিরলী গ্রামের বাসিন্দা মাজেদা বেগম বলছিলেন এমন কথা।
ফেনী সদর উপজেলার পাঁচগাছিয়া ইউনিয়নের বিরলী গ্রাম, বৃহস্পতিবার বিকালেও গ্রামের অধিকাংশ বাড়িঘর পানির নিচে ছিল। কোথাও হাঁটু পানি, আবার কোথাও কোমর সমান।
আট দিন ধরে বানের পানিতে ডুবে থাকা গ্রামটিতে নেই বিদ্যুৎ। এখনও গ্রামের স্কুল, মাদ্রাসা ও কিছু পাকা ভবনে আশ্রয় নিয়ে আছেন বেশ কিছু পরিবার।
গ্রামে যাবার মূল সড়কেরও বেশকিছু অংশ ডুবে আছে পানিতে। গ্রামের লোকদের সঙ্গে কথা হলে তারা বলেন, পানি আরও বেশি ছিল। তিন দিন হলো পানি নামা শুরু করেছে। রাস্তাগুলো গত সোমবার পর্যন্ত কোমর সমান পানিতে ডুবে ছিল।
দুপুরে বিরলী হাই স্কুলের সামনে দিয়ে আসার পথে দেখা গেল বড় দুটি পানির বোতল নিয়ে হাঁটু পরিমাণ পানি ভেঙে স্কুল থেকে বের হচ্ছেন মাজেদা বেগম।
এক মাঠের দুই প্রান্তে দুটি স্কুল। একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়, অন্যটি মাধ্যমিক। প্রাথমিকের একতলা ভবনটি পানিতে ডুবে গেছে। হাই স্কুলের দুই তলা ভবনের দ্বিতীয় তলায় গ্রামের ২৬টি পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। যেখানে আছে মাজেদার পরিবারও।
সেখানে কথা হলে মাজেদা বলেন, প্রাইমারি স্কুলের পেছনে তার ঘর। সেখানে তারা তিন পরিবার বাস করে। গত ২১ অগাস্ট থেকে তারা পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। পরদিন সকাল থেকে দ্রুত গতিতে পানি বেড়ে যায়।
মাজেদার সঙ্গে কথা বলার সময় সেখানে এলেন আরও কয়েকজন নারী ও পুরুষ, যাদের আশ্রয় হয়েছে বিরলী হাই স্কুলের দুই তলায়।
তাদের ভাষ্য- এককাপড়ে তারা বাড়ি থেকে বের হয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে এসেছিলেন। বানের পানিতে ঘরের চুলা থেকে শুরু করে হাঁড়ি-পাতিল সব ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। গ্রামের কিছু উচ্চবিত্ত লোক মিলে তাদের দুপুরে রান্না করা খিচুড়ি বা ডাল-ভাত খাওয়ান। আর অন্যবেলায় তারা মানুষের কাছ থেকে পাওয়া চিড়া, মুড়ি, বিস্কুটসহ শুকনো খাবার খান।
মাজেদা বলেন, “সবাই তো শুকনা খাবার দিয়ে যাচ্ছে, শুকনা খাবার কত খাইব? আমাগো রে কিছু চাইল-ডাইল দেন, রান্না করি।”
মাজেদার সুরে কথা বলেন রোকেয়া বেগমও।
“আর কত শুকনো খাবার খাইব? পানি নাই, ভাত নাই… তিন বেলা ভাত খাওয়া লোক আমরা। এক সপ্তাহ ধইরা এক বেলাও ভালো কইরা ভাত খাইতে পারি না।”
নুরুল আলম নামে আরেকজন ছিলেন, তার কথাও একই।
ক্ষুদার কষ্টে শিশুরা
হাই স্কুলের ভবনে আশ্রয় নেওয়া নারী মাইমুনা বেগম। স্কুলের বিপরীতে তার ঘর। ৯ দিন ধরে তাদের ঘর পানিতে ডুবে আছে।
মাইমুনা বলেন, তিন ও দেড় বছর বয়েসি দুই শিশু সন্তানকে নিয়ে স্বামীসহ আশ্রয় নিয়েছেন স্কুলে। খাবার আর পানির কষ্টে তার ছোট শিশুটি অসুস্থ হয়ে পড়েছে।
“আমরা তো কষ্ট করে খাই। কিন্তু ছোড পোলাগুলা তো বুঝে না। তারা ক্ষুদার জন্য কান্নাকাটি করে। আমার ১৫ মাস বয়েসি পোলাডা গতকাইল (বুধবার) থাইকা অসুস্থ। ডায়রিয়া হইছে।”
রওশন আরা নামে এক নারী হাত নির্দেশ করে তার ঘর দেখিয়ে বলেন, এখনও ঘরের ভেতর কোমর সমান পানি জমে আছে। আড়াই বছর বয়েসি কন্যা শিশুকে নিয়ে উঠেছেন আশ্রয়কেন্দ্রে।
“প্রতিদিন শুকনা খাবার খাইতে খাইতে আর কত খাইতে পারি! আমরা না হয় খাই। মাইয়াডা তো বুঝে না, সে তো খাইতে চাই না, কান্নাকাডি করে।”
বন্যায় ফেনীর সব উপজেলার অবস্থা এখনও ভয়াল। গত ১৯ অগাস্ট থেকে টানা বৃষ্টিতে নাকাল হতে শুরু ফেনী। পরদিন থেকে বন্যার ধাক্কায় জেলার উত্তরের পরশুরাম, ফুলগাজী, সদরের একাংশ, ছাগলনাইয়া উপজেলা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে।
তার দুই দিন পর থেকে সোনাগাজী, দাগনভূঁইয়াসহ ফেনীর দক্ষিণের বিভিন্ন গ্রাম ডুবতে থাকে। উত্তরে পানি নেমে যাওয়া শুরু হলেও আট দিন ধরে এখনও দক্ষিণের গ্রামের পর গ্রাম মানুষ পানিবন্দি।