বিএনপির নেতা-কর্মীরা মুন্সিগঞ্জের লৌহজং উপজেলার শিমুলিয়া ফেরিঘাট, মাছঘাট ও ট্রলারঘাট দখল করে চাঁদা তুলছেন। বৈধ ইজারাদারের লোকজনকে মারধর করে ঘাট থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে।
উপজেলার কুমারভোগ ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি কাউসার তালুকদারের নেতৃত্বে তার অনুসারীরা এ কাজ করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
ইজারাদার সূত্রে জানা যায়, পদ্মা সেতু চালু হওয়ার আগে শিমুলিয়া ফেরিঘাটটি যাত্রী পারাপারের জন্য ব্যবহার করা হতো। সেতু উদ্বোধনের পর ঘাট দিয়ে যাত্রী পারাপার বন্ধ হয়ে যায়। তবে প্রতিদিন হাজারো দর্শনার্থী এখানে বেড়াতে আসেন।চলতি অর্থবছরে বিআইডব্লিউটিএর কাছ থেকে লৌহজং উপজেলা কৃষক লীগের সাধারণ সম্পাদক সুলতান মোল্লা প্রায় ১ কোটি ৪২ লাখ টাকায় ঘাটের ইজারা নেন। সেই সঙ্গে আলাদা করে ৮ লাখ টাকায় এখানকার দুটি ট্রলার ঘাট এবং ১০ লাখ টাকায় একটি মাছ ঘাটেরও ইজারা নেন তিনি। সরকারি বিধি মেনে ঘাটের কার্যক্রম চলছিল।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দলটির গুরুত্বপূর্ণ নেতা-কর্মীরা আত্মগোপনে চলে গেলে কুমারভোগ ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি কাউসার তালুকদারের নেতৃত্বে ইউনিয়ন বিএনপি, যুবদল, ছাত্রদল, স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা-কর্মীদের একটি দল ঘাটের সব ব্যবসা তাদের দখলে নিয়ে ইজারাদারদের লোকজনকে টাকা তুলতে বাধা দেন। ১৬ আগস্ট ঘাটের পার্কিং, ট্রলার ঘাট, দোকান, রেস্তোরাঁ থেকে তারা নিজেরাই টাকা তুলতে শুরু করেন।
পরদিন ঘাটের দায়িত্বে থাকা উপজেলা ছাত্রলীগের সহসভাপতি শেখ মেহেদি হাসানকে বিএনপির ওই চক্রটি মারধর করে ঘাট থেকে বের করে দেয়। পরে ইজারাদার বিএনপি নেতা কাউসার তালুকদারের সঙ্গে সমঝোতায় আসেন। দেনদরবারের পর মোট আয়ের ১৬ ভাগের ৬ ভাগ কাউসার তালুকদারকে দিতে রাজি হন। তবে কাউসার তালুকদার শর্ত জুড়ে দেন, তার ছেলেরা ঘাটের টাকা তুলবে এবং ইজারাদারের ভাগের টাকা কাউসার নিজ হাত দিয়ে দেবেন। অনেকটা নিরুপায় হয়ে মেনে নেন ইজারাদার সুলতান মোল্লা।
সুলতান মোল্লা বলেন, মাছঘাট, ট্রলারঘাট, শিমুলিয়া ঘাট সবকিছুই কাউসার তালুকদার ও তার লোকজনের দখলে রেখেছে। আমরা কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছি। অথচ তারা বিনিয়োগ ছাড়াই ৩০ ভাগের বেশি আমাদের কাছ থেকে নিয়ে যেতে চাচ্ছেন। তাদের লোকজন দিয়ে তারা টাকা তুলছেন। তারা এখনো আমাদের ভাগের টাকা দেননি।
এদিকে দখলের অভিযোগ অস্বীকার করে বিএনপি নেতা কাউসার তালুকদার বলেন, কিছু ছাত্র, পোলাপান ঘাটে এসে ইজারাদারদের বিরক্ত করছিল। ইজারাদার, ইউএনও সাহেবের সঙ্গে বসেছিলাম। ইউএনও সাহেব সরকারি ইজারা যেন নষ্ট না হয়, আমাদের দেখে রাখতে বলেছেন। টাকা তুলে ভাগ-বাঁটোয়ারার বিষয়টি মিথ্যা। টাকা তোলার কাজে সেখানে শুধু আমাদের লোকই নয়, ইজারাদারের লোকজনও আছে। টাকা তুলে জমানো হচ্ছে। পরে এগুলো কীভাবে কী করা হবে, নির্ধারণ করা হবে।
লৌহজং উপজেলার ইউএনও মো. জাকির হোসেন বলেন, কাউসার সাহেবেরা যে কথা বলছেন, এমন কোনো কথা তাদের সঙ্গে আমার হয়নি। সরকার পতনের কয়েক দিন পর ঘাটের বিষয় নিয়ে কাউসার লোকজন নিয়ে আমার কাছে এসেছিলেন। আমি তাদের পুলিশ ও বিআইডব্লিউটিএর সঙ্গে কথা বলতে বলেছিলাম।
গত সোমবার বিকেলে শিমুলিয়া ঘাট এলাকায় সরেজমিনে দেখা যায়, ঘাটের পার্কিং মাঠের প্রবেশমুখে কয়েকজন ব্যক্তি মোটরসাইকেল, প্রাইভেটকার থামিয়ে টাকা তুলছেন। এ সময় তাদের সঙ্গে কথা হলে তারা জানান, তারা কাউসার তালুকদারের লোক। দিনপ্রতি ৫০০ টাকা মজুরিতে তারা কাজ করেন।
বিভিন্ন সূত্রের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রতিদিন পার্কিং এলাকা থেকে ৩০ হাজার টাকা তোলা হয়। এছাড়া মাঠে ১৫টি বড় খাবারের হোটেল এবং প্রায় আড়াই শতাধিকের মতো চা-কফি, শিশুদের খেলনাসহ বিভিন্ন পণ্যের ছোট দোকান রয়েছে। এসবের মধ্যে খাবারের হোটেল থেকে প্রতিদিন ২ হাজার টাকা এবং ছোট দোকান থেকে ২৫০ টাকা করে ভাড়া তোলা হচ্ছে।
টাকা তোলার দায়িত্বে রয়েছেন কাউসারের অনুসারী কুমারভোগ ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার হোসেন, কুমারভোগ ইউনিয়ন ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক সোহান মৃধা, ছাত্রদল নেতা মিলন ঢালী, ইউনিয়নটির ৯ নম্বর ওয়ার্ড যুবদল সভাপতি ইলিয়াস মাদবর, স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা অনিক হোসেন প্রমুখ। সবমিলিয়ে প্রতিদিন লক্ষাধিক টাকা অবৈধভাবে নিয়ে যাচ্ছেন কাউসার তালুকদারের লোকজন।
জানা যায়, মাছঘাট থেকে টাকা তোলেন লৌহজং উপজেলা ছাত্রদলের সদস্য সোহাগ মৃধা। ট্রলারঘাট থেকে স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা পারভেজ খান এবং বাসস্ট্যান্ড দখল করে শ্রমিক দলের নেতা জাকির হোসেন টাকা আদায় করছেন। তবে সোহান মৃধা বলেন, আমি একদিন ঘাটে গিয়েছিলাম। কাউসার তালুকদার ৪ জনকে ঘাটের দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়েছেন। আমি এগুলোর মধ্য নেই।
কুমারভোগ ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার হোসেন তাদের লোকজন দিয়ে টাকা তোলার বিষয়টি স্বীকার করেছেন। টাকা কীভাবে ভাগ হবে, এটি সভাপতি কাউসার তালুকদার জানেন বলে জানান এই নেতা।
মুন্সিগঞ্জ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্যসচিব ও দলটির কেন্দ্রীয় কমিটির সমাজকল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক কামরুজ্জামান রতন বলেন, শিক্ষার্থীরা একটি বৈষম্যবিরোধী দেশ গড়তে রক্ত দিয়েছেন। আমরাও এমন দেশ চাই। শুধু কুমারভোগ নয়, মুন্সিগঞ্জের যেখানেই দলের নাম ভাঙিয়ে যারা অন্যায় কাজ করছেন, তাদের বিরুদ্ধে আইনগত এবং সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হবে।